সেলফি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা
যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ি, বন্ধুদের জমায়েত বা সুন্দর কোনো জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে একা বা কয়েকজন মিলে মোবাইল ফোন আর ডিজিটাল ক্যামেরায় নিজেরাই তুলে ফেলছি নিজেদের ছবি—যাকে বলে সেলফি! কবে কখন প্রথম এই সেলফির প্রচলন হলো তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর। মার্কিন আলোকচিত্রী রবার্ট কর্নেলিয়াস ১৮৩৯ সালে নিজের ছবি নিজে তুলে পৃথিবীর প্রথম সেলফি তৈরি করেন। কিন্তু এ যুগে সেলফি বলতে যা বোঝায় সেই ‘সেলফি’ শব্দটি অস্ট্রেলিয়ার একটি অনলাইন ফোরাম সর্বপ্রথম ব্যবহার করে ২০০২ সালে। এরপর থেকে বিষয়টির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে—স্থান পায় অক্সফোর্ড অভিধানে এবং ২০১৩ সালে বর্ষসেরা শব্দের খেতাবও অর্জন করে ‘সেলফি’।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান, তারকা, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, পর্যটক, মহাশূন্যচারী, শিশু-যুবক-বৃদ্ধ—কে নেই সেলফি তোলার তালিকায়! কেন মানুষ সেলফি তোলে? কেনই বা সেগুলো ছেড়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? জানতে চেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্লেষণ করেছেন সেলফির মনস্তত্ত্ব।
২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘সাইকোলজি অব সেলফিজ’ নিবন্ধে গবেষক ক্রিস্টি বারলেট বলেন, যারা বেশি বেশি সেলফি তোলে ও পোস্ট করে তাদের বেশির ভাগের মধ্যেই রয়েছে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা এবং তারা কেউ কেউ ব্যক্তিজীবনে অনেকখানিই একা। অবশ্য এই নিবন্ধে মন্তব্য করা আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে অন্যের কাছে তুলে ধরাটা নান্দনিক আর এতে কোনো সমস্যা নেই। নানা অনলাইন মাধ্যমের বিশিষ্ট গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে সেলফির পক্ষে বেশ কয়েকটি যুক্তি প্রকাশ করা হয়। যেমন নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরা যায়, আবার অন্যেরা আপনাকে কেমন ভাবছে তাও সেলফির মাধ্যমে জানা যায়। সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত হতে সাহায্য করে সেলফি।
উদাহারণ হিসেবে জাপানি শিশুদের একাকিত্ব ও বিভিন্ন অ্যানিমেটেড খেলা ছেড়ে সমাজে সম্পৃক্ত হতে সেলফি কীভাবে সাহায্য করেছে তা বিবৃত করা হয়। নিজেকে একজন মানুষ যতটুকু মনে করে সে যে তার চাইতে আরও বেশি বড় তা সেলফির মাধ্যমে প্রমাণ হতে পারে, হতে পারে দ্রুত যোগাযোগের বিকল্প। ‘আমার এই পোশাকটি কেমন’ সঙ্গে সঙ্গে সে অনেকের মতামত পেয়ে যায়, অন্যের কাছে স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে সে তার চাহিদার সোপানের একধাপ ওপরে উঠে যেতে পারে, মনোবল বেড়ে যায়, সাজানো-গোছানো ফরমায়েশি ছবির চেয়ে সেলফি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত ও প্রাকৃতিক। এতে প্রকৃত মানুষটিকে চেনা যায়, পর্যায়ক্রমিক সেলফির মাধ্যমে একজন মানুষের রুচি ও মানসিকতার পরিবর্তনও অনুসরণ করা যায়।
সেলফির এত গুণগান সত্ত্বেও সমস্যা মাঝেমধ্যে হয় বৈকি। যুক্তরাজ্যের ড্যানি বোম্যান বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন সেলফি নিয়ে। চলতি বছরের মার্চে ডেইলি মিরর-এ প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ১৯ বছর বয়সী বোম্যান মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন—যার কারণ সেলফি! তিনি তিন বছর আগে থেকে সেলফি পোস্ট করেন। কিন্তু তাঁর চেহারার বিষয়ে বন্ধুদের বক্রোক্তি নিয়ে তিনি বিচলিত হন এবং বছর দুয়েক ধরে প্রতিদিন গড়ে ২০০টি সেলফি পোস্ট করতে থাকেন, এর জন্য দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করতেন। সেলফি না তুললে তাঁর তীব্র উৎকণ্ঠা হতে থাকত। একপর্যায়ে সুন্দর একটি সেলফি দিতে না পারার যন্ত্রণায় তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
উদ্ধারের পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, বোম্যানের বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার ও অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার নামের মানসিক সমস্যা রয়েছে। লন্ডনের মোউস্ডলে হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ভিয়ালে মন্তব্য করেন, সম্প্রতি সেলফিকেন্দ্রিক মানসিক সমস্যা নিয়ে তরুণ-তরুণীরা হাসপাতালে আসছে। গত বছরের এপ্রিলে সাইকোলজি টুডে-তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে মনোবিশ্লেষক ড. পামেলা রূটলেজ সেলফির কারণে মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তিনি মনে করেন, বেশি বেশি সেলফি পোস্ট যারা করে তারা মূলত একাকী ও তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কম। আত্মপ্রেম বা নার্সিসিজমের সঙ্গেও সেলফির যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা। কোনো কোনো গবেষকের মতে, নার্সিসিস্টিক ব্যক্তিত্বের সমস্যার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত সেলফি তোলার সম্পর্ক রয়েছে।
এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন তাঁরা নিজের গুরুত্ব, ক্ষমতা, সৌন্দর্য নিয়ে সব সময় আচ্ছন্ন থাকেন ও সেগুলোকে লালন ও প্রচার করতে আগ্রহী হন। এই বিবেচনায় এঁরা মাত্রাতিরিক্ত সেলফি ব্যবহার করতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। সেলফির কারণে অনেক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হতে পারে, এটি প্রতিরোধে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা জরুরি। অনেক সময় সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে—সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় চলন্ত গাড়িতে সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে জেনিয়া নামের এক তরুণী এ বছরের এপ্রিল মাসে তার ১৮তম জন্মদিনে একটি রেলব্রিজের ওপর ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
সেলফি নিয়ে থাকতে পারে বিতর্ক। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বিপ্লবের এই যুগে সেলফিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সেলফি তুলুন, পরিমিতভাবে।
আত্মবিশ্বাসী হোন, প্রকৃত নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসুন। নিজেকে অপরের কাছে মেলে ধরুন আপনার কাজ আর ভাবনা দিয়ে—সেই প্রক্রিয়ায় সেলফিও থাকবে কিন্তু পরিমিত পরিমাণে, শিষ্টাচারের মধ্যে থেকে।
সেলফির কিছু শিষ্টাচার
আপনার সেলফিতে অন্যের মুখাবয়ব চলে এলে তার অনুমতি নিন।
সামাজিক রীতি ও প্রচলিত আইন মেনে ছবি তুলুন।
নিজের ও অপরের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলুন ও পোস্ট করুন, অযথা ঝুঁকি নেবেন না।
অপরের প্রতি সম্মান দেখান, হাস্যরসের নামে অশালীনতা যেন না প্রকাশ পায়।
অন্যের সেলফিতে কটু ও ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করবেন না।
সেলফি তোলার সময় আশপাশের মানুষ যেন বিরক্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
দলবেঁধে সেলফি তোলার সময় অপরের চলার পথ বন্ধ করবেন না।
ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে সেলফি তোলা থেকে বিরত থাকুন।
সেলফির কারণে অপরের সঙ্গে বিবাদে জড়াবেন না।
সেলফি তোলা, পোস্ট করা ইত্যাদি আপনার কাজ, পড়ালেখা, চাকরি ও প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোকে বিঘ্নিত করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
Post a Comment